লাহোর প্রস্তাবের অনেক আগেই ১৯৩০ সালে কবি আল্লামা ইকবাল মুসলমানদের জন্য আলাদা রাষ্ট্রের কথা উল্লেখ করেছেন । ১৯৩৩ সালে কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র চৌধুরী রহমত আলী ভারতের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম এলাকাগুলো নিয়ে পাকিস্তান নামক একটি রাষ্ট্রের রূপরেখা অঙ্কন করেন । ১৯৩৭-৩৮ সাল পর্যন্ত মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ মুসলমানদের জন্য পৃথক রাষ্ট্রের কথা ভাবেননি। কিন্তু ১৯৩৭ সালে নির্বাচনের তিক্ত অভিজ্ঞতা এবং নির্বাচনের পরে বিজয়ী কংগ্রেস সভাপতির বক্তব্যে তিনি বুঝতে পারেন যে, সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়ের আশা-আকাঙ্ক্ষা হিন্দু নেতৃবৃন্দের শাসনাধীনে বাস্তব রূপ লাভ করবে না । সার্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি, অতীতের তিক্ত অভিজ্ঞতা এবং মুসলমানদের স্বার্থের কথা বিবেচনা করে ১৯৩৯ সালে জিন্নাহ তাঁর বহুল আলোচিত-সমালোচিত দ্বি-জাতি তত্ত্বের ঘোষণা দেন। ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাব মূলত তার এই ঘোষণার বাস্তব রূপ দেওয়ার পথনির্দেশ করে ।
১৯৪০ সালের ২৩শে মার্চ মুসলিম লীগের লাহোর অধিবেশনে এই প্রস্তাবটি গৃহীত হয় বলে এটি ইতিহাসে লাহোর প্রস্তাব নামে খ্যাত। উপমহাদেশের মুসলমানদের রাজনৈতিক ইতিহাসে লাহোর প্রস্তাব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ছিলেন এই অধিবেশনের সভাপতি। এ কে ফজলুল হক ২৩শে মার্চের অধিবেশনে তাঁর রচিত প্রস্তাবটি উত্থাপন করেন। লাহোর প্রস্তাবে বলা হয়, কোনো শাসনতান্ত্রিক পরিকল্পনা এদেশে কার্যকর হবে না, যদি এটি লাহোর প্রস্তাবে উত্থাপিত মূলনীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত না হয়।
লাহোর প্রস্তাবের পটভূমি:
বেঙ্গল প্যাক্ট অকার্যকর হলে হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের সম্ভাবনা ব্যাহত হয়। অপরদিকে সাইমন কমিশন গঠনের বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ কংগ্রেস ভারতবাসীর জন্য উপযোগী শাসন সংস্কারের চেষ্টা চালায়। এ পরিস্থিতিতে ১৯২৮ সালের আগস্ট মাসে মতিলাল নেহরুর নেতৃত্বে গঠিত কমিটি একটি রিপোর্ট পেশ করে। নেহরু রিপোর্ট নামে খ্যাত রিপোর্টটিতে যে সুপারিশ করা হয় তা হলো- ভারতের জন্য স্বাধীনতার পরিবর্তে ব্রিটিশ ডোমিনিয়নের মর্যাদা প্রদান, দায়িত্বশীল সরকার গঠন, সিন্ধু ও কর্ণাটক প্রদেশ সৃষ্টি। এছাড়া বাংলা ও পাঞ্জাবের আইনসভায় সংরক্ষিত আসন প্রথা বিলোপ সাধন। নেহরু রিপোর্ট মুসলমানদের পৃথক নির্বাচনের প্রথা অবসানে সুপারিশ করে মুসলিম নেতারা দলমত নির্বিশেষে এ রিপোর্টের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানান। ফলে নেহরু রিপোর্টের মাধ্যমে হিন্দু - মুসলিম সমঝোতার প্রচেষ্টাও ব্যর্থ হয়। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহও দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে ঐক্য স্থাপন প্রচেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে ১৯২৯ সালে তার বিখ্যাত ১৪ দফা উত্থাপন করেন। এর মধ্যে মুসলমান সম্প্রদায়ের স্বার্থ সংরক্ষণের বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব লাভ করে। এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সাম্প্রদায়িক চেতনা প্রবল হতে থাকে এবং দুই সম্প্রদায়ের মধ্যকার দূরত্ব ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে।
১৯৩০ সালে প্রকাশিত সাইমন কমিশনের রিপোর্ট সব রাজনৈতিক দল প্রত্যাখ্যান করে । ১৯৩০-১৯৩২ সাল পর্যন্ত লন্ডনে আহূত পরপর তিনটি গোলটেবিল বৈঠক বিভিন্ন সম্প্রদায়ের আসন সংরক্ষণের দাবির বিষয়ে একমত হতে না পারার কারণে সমঝোতা ছাড়াই পরিসমাপ্তি ঘটে । এ সময়ে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের নেতৃবৃন্দ এই সমস্যা সমাধানের জন্য ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর ওপর চাপ প্রয়োগ করেন । ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী রামজে ম্যাকডোনাল্ড সমস্যা সমাধানের জন্য 'সাম্প্রদায়িক রোয়েদাদ' ঘোষণা করেন । সেখানে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের জন্য কিছু আসন সংরক্ষণের ব্যবস্থাসহ পৃথক নির্বাচনের সুযোগ দেওয়া হয় । ‘সাম্প্রদায়িক রোয়েদাদ’ বিভিন্ন সম্প্রদায় ও দলের মধ্যে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে । তবে মুসলমানরা প্রতিবাদ সত্ত্বেও সাম্প্রদায়িক রোয়েদাদ গ্রহণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে । এরপর যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার পদ্ধতি এবং প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন প্রবর্তনের বৈশিষ্ট্য সংবলিত ভারত শাসন আইন ১৯৩৫ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে গৃহীত হয় । এই আইন ভারতবর্ষের শাসনতান্ত্রিক ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ দলিল হলেও এই আইন অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা প্রবর্তন করা সম্ভব হয়নি । কারণ জিন্নাহ এই আইনে প্রস্তাবিত যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার সমালোচনা করেন ।
অপরদিকে কংগ্রেস সভাপতি রাজেন্দ্রপ্রসাদ এর তীব্র সমালোচনা করে বলেন, এই আইনে স্বায়ত্তশাসনের স্বাভাবিক অগ্রগতির কোনো লক্ষণ নেই । উভয় দলই ভারতের জন্য অধিকতর শাসনতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক সংস্কার দাবি করে । অপরদিকে হিন্দু মহাসভা এই আইনের বিরোধিতা করে। দলগুলোর বিরূপ প্রতিক্রিয়া সত্ত্বেও ১৯৩৭ সালে এই আইনের অধীনে প্রস্তাবিত প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন ব্যবস্থা কার্যকর করা হয় । অপরদিকে প্রাদেশিক নির্বাচনে অধিকাংশ প্রদেশে কংগ্রেস সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়লাভ করে । এ অবস্থায় মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশগুলোতে মুসলিম লীগের সঙ্গে কোনো রকম আলোচনা ছাড়াই কংগ্রেস মন্ত্রিসভা গঠন করে । তাছাড়া কংগ্রেস সভাপতি জওহরলাল নেহরু নির্বাচন পরবর্তীকালে মন্তব্য করেন যে, ভারতে দুইটি শক্তির অস্তিত্ব লক্ষণীয়- একটি সরকার, অপরটি কংগ্রেস । তাঁর এ ধরনের মন্তব্য মুসলিম নেতাদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। জিন্নাহ যিনি দীর্ঘ সময় ধরে হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন, তিনি কংগ্রেস সভাপতির বক্তব্যের কারণে রাজনীতির ভিন্ন পথে অগ্রসর হন । ১৯৩৮ সালে তিনি সিন্ধুতে প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভায় হিন্দু ও মুসলমান দুইটি ভিন্ন জাতি বলে উল্লেখ করেন । এভাবে লাহোর প্রস্তাবের আগেই হিন্দু-মুসলমান আলাদা জাতি- এই চিন্তা করার ফলে তাদের জন্য আলাদা রাষ্ট্রের চিন্তারও প্রকাশ ঘটতে থাকে । এই প্রকাশের বাস্তব উদাহরণ হচ্ছে ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাব ।
লাহোর প্রস্তাবের প্রধান ধারাসমূহ-
ক. ভারতের উত্তর-পশ্চিম এবং পূর্ব ভূ-ভাগের মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলগুলোকে নিয়ে স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহ গঠন করতে হবে ।
খ. এসব স্বাধীন রাষ্ট্রের সংশ্লিষ্ট অঙ্গ রাষ্ট্রগুলো স্বায়ত্তশাসিত ও সার্বভৌম হবে।
গ. সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলোর সাথে পরামর্শ করে তাদের সব অধিকার এবং স্বার্থরক্ষার জন্য সংবিধানে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা রাখতে হবে।
ঘ. প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র, যোগাযোগ ইত্যাদি বিষয়ে ক্ষমতা সংশ্লিষ্ট অঙ্গ রাজ্যগুলোর হাতে ন্যস্ত থাকবে ।
উল্লিখিত প্রস্তাবের ধারাসমূহের কোথাও পাকিস্তান শব্দটির উল্লেখ নেই। কিন্তু তৎকালীন বিভিন্ন পত্রিকার এটিকে পাকিস্তান প্রস্তাব বলে প্রচার হতে থাকে। ফলে দ্রুত এ প্রস্তাব 'পাকিস্তান প্রস্তাব' হিসেবে পরিচিত্তি লাভ করতে থাকে ।
লাহোর প্রস্তাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম অঞ্চলগুলো নিরে রাষ্ট্রসমূহ গঠন করার কথা বলা হয়েছিল। যার ফলে বাঙালি মুসলমান পূর্নাংশ নিয়ে একটি 'স্বাধীন বাংলা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেছিল। কিন্তু ১৯৪৬ সালের এই এপ্রিল দিল্লিতে মুসলিম লীগের দলীয় আইনসভার সদস্যদের এক কনভেনশনে নীতি-বহির্ভূতভাবে জিন্নাহ 'লাহোর প্রস্তাব' সংশোধনের নামে ভিন্ন একটি প্রস্তাব উত্থাপন করেন। এতে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলসমূহ নিয়ে একটি রাষ্ট্র গঠনের কথা বলা হয়। সুতরাং বলা যেতে পারে যে, ১৯৪০ সালে লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে নয়, ১৯৪৬ সালের এপ্রিল মাসে উত্থাপিত দিল্লি প্রস্তাবের ভিত্তিতে পাকিস্তানের জন্ম হয়।
লাহোর প্রস্তাবের গুরুত্ব:
লাহোর প্রস্তাবের প্রতি কংগ্রেস নেতাদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু এই প্রস্তাবের তীব্র নিন্দা করেন। তবে ঐতিহাসিক সত্য এই যে, লাহোর প্রস্তাবের পর থেকে মুসলমান সম্প্রদায় নিজস্ব আলাদা রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখতে থাকে। এই প্রভাবের পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের রাজনৈতিক-শাসনতান্ত্রিক আন্দোলনে এক নতুন ধারার জন্ম হয়। দ্বি-জাতি তত্ত্বের মাধ্যমে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ মুসলমানদের আলাদা জাতি হিসেবে চিহ্নিত করতে থাকেন। সে অনুযায়ী মুসলমানদের জন্য ভিন্ন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা শুধু সময়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায় । এরপর থেকে মুসলিম লীগ এবং জিন্নাহর রাজনীতি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র গঠন প্রক্রিয়ার দিকে ধাবিত হতে থাকে; যার শেষ পরিণতি ছিল ১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসের দেশ বিভাগ। দ্বি-জাতি তত্ত্বের বাস্তব পরিণতিতে ১৪ই আগস্ট পাকিস্তান এবং ১৫ই আগস্ট ভারত নামে দুইটি রাষ্ট্রের জন্ম হয়।
Read more